The Red-Headed League - দ্য রেড-হেডেড লীগ
Written By স্যার আর্থার কোনান ডয়েল
Posted On: November 19, 2024
গত বছর শরতে গিয়েছিলাম বন্ধুবর শার্লক হোমসের সঙ্গে দেখা করতে। গিয়ে দেখি লালমুখো, মোটাসোটা এক বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপে মগ্ন ও। শুধু চেহারাই নয়, লোকটার মাথার চুলও আগুনের মতো লাল। অসময়ে হঠাৎ ঢুকে পড়বার জন্যে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে আসছিলাম, এমন সময় হোমস আমাকে ভেতরে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। সহাস্যে বলল, 'একেবারে সময়মতো চলে এসেছ, ওয়াটসন।'
'তুমি দেখছি আলোচনায় ব্যস্ত।'
'খুব ব্যস্ত।'
'আমি তাহলে পাশের ঘরে গিয়ে বসি।'
'মোটেই না। মি. উইলসন, ও আমার সহকর্মী এবং সহযোগী। এর আগে অনেক কেসে আমাকে সাহায্য করেছে। ওকে দিয়ে আপনারও উপকার হবে।'
চেয়ার থেকে অর্ধেকটা উঠে, চর্বি-ঢাকা কুতকুতে চোখের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমাকে দেখলেন ভদ্রলোক। তারপর মাথাটা সামান্য নুইয়ে ফের বসে পড়লেন চেয়ারে।
আমাকে বসতে বলে হোমসও আবার আর্মচেয়ারে গা এলিয়ে দিল। তারপর বলল, 'আমি জানি, ওয়াটসন, আমার মতোই তোমারও অসাধারণ এবং গতানুগতিকতার বাইরের জিনিসের প্রতি আকর্ষণ আছে। সেই ভালোবাসা থেকেই আমার কেসগুলো লিখে রাখছ। অবশ্য আমার অনেক ছোটখাটো কাজকেই তুমি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে লিখেছ।'
'তোমার এসব কেসের ব্যাপারে আমার সত্যিই খুব আগ্রহ।'
'মিস মেরি সাদারল্যান্ডের কেসটার ১৪৫ কথা মনে আছে? ছোট একটা সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন মহিলা। ওই কেসটায় হাত দেবার আগে তোমাকে বলেছিলাম, বিস্ময়কর ফল এবং অবিশ্বাস্য সব ঘটনার খোঁজ পেতে হলে আমাদেরকে সেই বাস্তবজীবনের কাছে গিয়েই হাত পাততে হবে। যেকোনো কল্পকাহিনির চাইতে বাস্তবজীবন অনেক বেশি রোমাঞ্চকর এবং দুঃসাহসিক।'
'তোমার এই বক্তব্যে আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম।'
'তা জানিয়েছিলে, ডাক্তার। কিন্তু তারপরও আমার বক্তব্য তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে। একের পর এক এমন সব ঘটনার উদাহরণ হাজির করব যে. বিশ্বাস না করে পারবে না। যাকগে, এবার আসল কথায় আসি। মি. জ্যাবেষ উইলসন একটা অসাধারণ কেস নিয়ে এসেছেন। এমন অদ্ভুত, অস্বাভাবিক ঘটনার কথা ইদানীংকালে আর শুনিনি। তোমাকে আগেও বলেছি, সবচেয়ে অদ্ভুত আর অস্বাভাবিক ঘটনার পেছনে বড় কোনো অপরাধ নয়, থাকে ছোট ছোট অপরাধ। অনেকসময় ওসব ঘটনার পেছনে অপরাধের ছায়াও থাকে না।
মি. উইলসনের কেসটার সাথে কোনো অপরাধের ব্যাপারস্যাপার জড়িয়ে আছে কিনা, তা-ও বলা যাচ্ছে না। তারপরও বলব, এমন বিচিত্র কেস আগে কখনো আমার হাতে আসেনি। মি. উইলসন, দয়া করে গোটা ব্যাপারটা আরেকবার গোড়া থেকে বললে খুব ভালো হয়। ডা. ওয়াটসন শোনেনি বলেই যে আপনাকে দিয়ে আবার বলাচ্ছি তা নয়, কাহিনিটা বিশ্লেষণ করার জন্যেই আরেকবার শোনা দরকার আমার।'
গর্বিত ভঙ্গিতে বুক ফুলিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন আমাদের মক্কেল। তারপর একটা ময়লা, দোমড়ানো খবরের কাগজ বের করলেন কোটের পকেটে থেকে। কাগজটা হাঁটুর ওপর মেলে ধরে একটা বিজ্ঞাপন দেখতে লাগলেন। সেই যাঁকে আমিও মানুষটাকে দেখে নিলাম ভালোমতো। হোমসকে অনুকরণ করে পোশাক আর চেহারা থেকে মানুষটার চরিত্র বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলাম। খুব একটা সুবিধে করতে পারলাম না।
ভদ্রলোক বেশ মোটাসোটা। পোশাকআশাক, হাবভাবে একটা জাঁক আছে। কাজেকর্মে একটু ধীর। সাধারণ ইংরেজ ব্যবসায়ীরা যেমন হয় আরকি। পরনে ধূসর রঙের ডোরাকাটা ট্রাউজার, ময়লা রঙের বোতামখোলা কালো ফ্রক-কোট, আর পেতলের ভারী অ্যালবার্ট-চেইন লাগানো ওয়েস্টকোট। একটা ফুটো করা চৌকো ধাতুর মুদ্রা ঝুলছে ওয়েস্টকোট থেকে। একটা টপ-হ্যাট আর ভেলভেট রঙের কুঁচকানো কলারঅলা রংচটা ওভারকোট পড়ে রয়েছে পাশের চেয়ারের ওপর। মোদ্দাকথা, মাথায় আগুনলাল চুল আর মুখের তীব্র বিরক্তি ও অসন্তোষের ছায়া ছাড়া বলার মতো আর কোনো বৈশিষ্ট্য নেই ভদ্রলোকের।
আচমকা আমার ওপর চোখ পড়ল হোমসের। আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে হেসে বলল, 'মি. উইলিয়ামস একসময় প্রচুর পরিশ্রম করতেন, নিয়মিত নস্যি নেন। উনি ফ্রিম্যাসন। চীনেও গিয়েছিলেন। ইদানীং বেশ লেখালেখি করছেন। বস, আমিও এর বেশি আন্দাজ করতে পারছি না।'
ওর কথা শুনে চমকে উঠলেন মি. উইলসন। তার আঙুল খবরের কাগজের ওপর, কিন্তু দুই চোখ স্থির আমার বন্ধুর দিকে।
'আপনি এসব কথা জানলেন কীভাবে, মি. হোমস?' সবিস্ময়ে বললেন তিনি। 'সত্যিই আমি একসময় প্রচুর পরিশ্রম করতাম। প্রথম জীবনে জাহাজে ছুতোর মিস্ত্রির কাজ করেছি। কিন্তু সে কথা আপনি জানলেন কী করে?' 'আপনার হাতই জানিয়েছে। আপনার ডান হাতটা বাঁ হাতের চাইতে বড়।
ওই হাত দিয়ে আপনি কাজ করেছেন, তাই ওটার পেশি বেড়েছে বেশি।'
'কিন্তু নস্যি, ফ্রিম্যাসন-ওসব?' 'নস্যির ব্যাখ্যা দিয়ে আপনার বুদ্ধিকে খাটো করতে চাই না। আর ফ্রিম্যাসন? ওটা আপনার ব্রেস্টপিন দেখেই বোঝা যায়।'
'ও হ্যাঁ, ওটার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু লেখার ব্যাপারটা?'
'আপনার ডান হাতার কাফটা পাঁচ ইঞ্চি জুড়ে চকচক করছে। আর লেখার সময় বাঁ হাতের কনুইয়ের যেখানটা টেবিলের ওপর রাখতে হয়, ওখানে কালচে দাগ পড়ে গেছে। এসব দেখে এছাড়া আর কী ভাবব বলুন?'
'তা নাহয় বুঝলাম, কিন্তু চীন?'
'ডান কবজিতে একটা মাছের উল্কি আঁকিয়েছেন। উল্কি নিয়ে আমার অল্পবিস্তর পড়াশোনা আছে। এ সংক্রান্ত সাহিত্যে খানিকটা অবদানও আছে অধমের। মাছের আঁশগুলো বিশেষ কৌশলে লাল রং করা। কৌশলটা কেবল চীনারাই ব্যবহার করে। তাছাড়া আপনার ঘড়ির চেইনে লটকানো চীনা মুদ্রাটাও গলা ফাটিয়ে জানান দিচ্ছে, চীনের জল-হাওয়া খেয়ে এসেছেন আপনি।'
হো-হো করে হেসে উঠলেন মি, জ্যাবেষ উইলসন। 'ওহ, এই ঘটনা। ভেবেছিলাম না জানি কী অসাধারণ বুদ্ধির খেলা খেলেছেন।'
'ওয়াটসন, সবকিছু খোলাসা না করলেই ভালো হতো দেখছি,' আমার দিকে ফিরে বলল হোমস। 'মানুষকে যত অন্ধকারে রাখবে, ততই বাড়বে তোমার গুরুত্ব। এভাবে সরল মনে সবাইকে সব বলে দিলে ব্যবসার সুনাম বলতে কিছু থাকবে না। যাকগে, বিজ্ঞাপনটা পেলেন, মি. উইলসন?'
'হ্যাঁ, পেয়েছি। এই দেখুন,' কলামের মাঝখানে লালচে মোটা আঙুল চেপে ধরে বললেন তিনি। 'এই বিজ্ঞাপন থেকেই সব গোলমালের শুরু। নিন, স্যার, আপনি নিজেই পড়ে দেখুন।'
ভদ্রলোকের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে পড়তে লাগলাম।
লালচুলো সংঘের প্রতি
যুক্তরাষ্ট্রনিবাসী প্রয়াত এযেকিয়াহ হপকিন্সের উইল অনুসারে লালচুলো সংঘে আরেকটি সদস্যপদ শূন্য হয়েছে। সকল চালচুলোকে নামমাত্র কাজের বিনিময়ে হস্তায় চার পাউন্ড বেতন দেয়া হবে। আবেদনকারীকে সুস্থ দেহ-মনের অধিকারী হতে হবে, বয়স হতে হবে একুশের বেশি। চুলের রং লাল হওয়া আবশ্যক। এই শর্তসমূহ যারা পূরণ করবেন, তারা সবাই এই পদ পাবার যোগ্য। আবেদনপত্র নিয়ে সোমবার বেলা এগারোটায়, ফ্লিট স্ট্রিটের সাত নম্বর পোপস কোটে ডানকান রসের সঙ্গে দেখা করুন।
'এ কেমনতর পাগলামি? মানে কী এসবের?' বিজ্ঞাপন পড়া শেষ করে হতভম্ব হয়ে বললাম আমি।
শরীর দুলিয়ে হেসে উঠল হোমস। খুশি খুশি গলায় বলল, 'ব্যাপারটা একটু বেখাপ্পা, তাই না? মি. উইলসন, এবার আপনার আর্থিক অবস্থা, আপনার ওপর বিজ্ঞাপনটার প্রভাব-সব খুলে বলুন। ডাক্তার, তার আগে তুমি কাগজটার নাম আর তারিখ লিখে নাও।'
ভদ্রলোকের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে পড়তে লাগলাম
দ্য মর্নিং ক্রনিকল। দু-মাস আগের১০১ তারিখ-২৭ এপ্রিল, ১৮৯০।'
' 'বেশ। এবার বলুন, মি. উইলসন।'
'আপনাকে তো বলেছিই, মি. হোমস, আমার একটা ছোটখাটো বন্ধকি কারবার আছে,' কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বলতে শুরু করলেন জ্যাবেষ উইলসন। 'শহরের কাছেই, কোবার্গ স্কয়ারে, ছোট ব্যবসা, অবস্থা অত ভালো না। কোনোমতে খাওয়া-পরা চলে যায় আরকি। এককালে দুজন সহকারী ছিল, কিন্তু এখন আছে মাত্র একজন। ওকেও ঠিকমতো রাখতে হলে অনেক টাকা মাইনে দিতে হতো। কিন্তু কাজ শেখার জন্যে হাফ-মাইনেতে চাকরিতে থেকে গেল ও।'
'ছোকরার নাম কী?' জানতে চাইল হোমস। 'ভিনসেন্ট স্পন্ডিং। বয়স একেবারে কম না। তবে ঠিক কত, তা বলা শক্ত। ওরকম আরেকটা চটপটে সহকারী পাওয়া বড় মুশকিল। খুব ভালো করেই জানি, চাইলেই আরো উন্নতি করতে পারবে ও। আমি যে বেতন দিই, তার দ্বিগুণ কামাতে পারবে। কিন্তু স্পন্ডিং ওই বেতনেই সন্তুষ্ট। চমৎকার ছেলে। আজকাল এরকমটা পাওয়া যায় না।
'তবে ছোট্ট একটা দোষও আছে ওর। ছেলেটা ফটোগ্রাফি বলতে পাগল। যখন-তখন কাজ শিকেয় তুলে ক্যামেরা নিয়ে ছোটে। আর ফিরে এসেই খরগোশের মতো সেঁধিয়ে যায় মাটির নিচের ঘরে, ফটোগুলো ডেভেলপ করতে। এছাড়া আর কোনো দোষ নেই।'
'এখনো কাজ করছে আপনার ওখানে?'
'হ্যাঁ। ও ছাড়া একটা মেয়েও থাকে। বছর চোদ্দ বয়স। রান্নাবান্না করে, ঘরদোর পরিষ্কার রাখে। আমি বিপত্নীক, ছেলেপুলেও হয়নি। এই তিনজনে মিলে বেশ শান্তিতে ছিলাম। মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই আছে, কারো কাছে কোনো
ধারদেনা নেই-নিরুপদ্রব জীবন।
'কিন্তু ওই বিজ্ঞাপনটাই আমাকে ঘরছাড়া করল। হপ্তা আষ্টেক আগে একদিন বিজ্ঞাপনটা নিয়ে হাজির স্পন্ডিং। এসেই আফসোস করতে করতে বলল, "মি. উইলসন, আমার মাথার চুলগুলো যদি লাল থাকত, বড় ভালো হতো।"
'অবাক হয়ে জানতে চাইলাম ব্যাপারটা কী। তখন বিজ্ঞাপনটা দেখিয়ে বলল, 'এই দেখুন, লালচুলো মানুষদের জন্যে চাকরি খালি হয়েছে একটা। লালচুলোরা তো বেশ দু-পয়সা কামিয়ে নেবে। ব্যাটারা বোধহয় টাকার বস্তা নিয়ে বসেছে। আমার চুলের রংটা লাল হলে আবেদন করতাম। সবাই কিন্তু দরখাস্ত করতে পারবে না। লন্ডনের খাস বাসিন্দা হতে হবে। এযেকিয়াহ হপকিন্স নামে এক খ্যাপা আমেরিকান কোটিপতির মাথার চুল ছিল আগুনলাল। তাই লালচুলো লোকদের জন্যে মায়া ছিল তার। ভদ্রলোক লন্ডন থেকে আমেরিকায় গিয়ে অঢেল টাকা কামিয়েছিলেন। মি. উইলসন, আপনি কিন্তু চাইলে আবেদন করতে পারেন।"
'দেখতেই পাচ্ছেন, আমার মাথার চুল আগুনের মতোই লাল। কিছুদিন ধরে ব্যবসা ভালো যাচ্ছিল না। তাই লোভে পড়ে দোকানপাট বন্ধ করে ছুটলাম ফ্লিট স্ট্রিটে। স্পন্ডিংকেও নিলাম সঙ্গে।
'জায়গামতো গিয়ে তো আমার মাথা ঘুরে গেল, মি. হোমস। অমন দৃশ্য জীবনে আর কখনো দেখিনি। উত্তর-দক্ষিণ, পুব-পশ্চিম-সবদিকে কেবল মানুষ আর মানুষ। যার চুলে এতটুকু লালের ছোঁয়া আছে, সে-ই এসে হাজির হয়েছে চাকরির আশায়। লালমাথা মানুষের ভিড়ে ফ্লিট স্ট্রিটের একটা মাছি পর্যন্ত গলবার জো নেই।
'পোপস কোর্ট দেখে মনে হচ্ছিল, ফলের দোকানে কমলার পাহাড় জমেছে যেন। খড়, লেবু, কমলা, ইট, মেটে-সব রঙের মেলা বসেছে। কিন্তু স্পল্ডিং বলল, আসল আগুনে রঙের চুল কারো নেই। এত লোকের ভিড় দেখে আমি তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু ও দমল না। ধাক্কা-গুঁতো মেরে আশ্চর্য কায়দায় ভিড় ঠেলে, সিঁড়ি ভেঙে এক্কেবারে অফিসঘরের সামনে নিয়ে হাজির করল আমাকে।
'সিঁড়িতেও লালচুলোদের স্রোত। একদল বুকভরা আশা নিয়ে ওপরে উঠছে, আরেকদল চাকরি না পেয়ে নেমে আসছে মুখ কালো করে। ব্যর্থদের লাইন দেখে আমারও মনটা দমে গেল। কিন্তু ঠেলে-ধাক্কিয়ে আমাকে অফিসে ঢুকিয়ে দিল স্পন্ডিং।'
এই পর্যন্ত বলে দম নেয়ার জন্যে থামলেন মি. উইলসন। নস্যি নিলেন একটিপ। এই ফাঁকে হোমস মন্তব্য করল, 'অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আপনার। তারপর কী হলো বলুন।'
'অফিসের ভেতরে একজোড়া কাঠের চেয়ার-টেবিল ছাড়া আর কিচ্ছু ছিল না,' আগের কথার খেই ধরলেন আমাদের মক্কেল। 'টেবিলের পেছনে একজন লালচুলোকে বসে ছিলেন। তার চুল আমার চাইতেও লাল। প্রত্যেক প্রার্থীকেই কোনো-না-কোনো ত্রুটি ধরে মুহূর্তের মধ্যে বাতিলের খাতায় ফেলে দিচ্ছিলেন। ব্যাপার দেখে মনটা দমে গেল। কিন্তু আমার পালা আসতে বেশ অমায়িক সুরে কথা বলতে লাগলেন ভদ্রলোক। উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন গোপনে কথা বলবার জন্য।
"ইনি মি. জ্যাবেষ উইলসন,' স্পন্ডিং বলল। "সংঘের শূন্য পদে চাকরি করতে চান।"
"হ্যাঁ, প্রয়োজনীয় সব গুণই আছে ওনার," লোকটা জবাব দিলেন। "ওর চেয়ে ভালো প্রার্থী আর আসেনি।" বলেই ঘুরে-ফিরে দেখতে লাগলেন আমাকে। খুব অস্বস্তি লাগছিল। তারপর হঠাৎ লাফিয়ে এসে আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, "সব দেখার পরও সন্দেহ করা অন্যায় হবে, তবু আরেকটু সতর্ক হলে আশা করি আপনি কিছু মনে করবেন না।"
'এই বলে আচমকা আমার চুল ধরে এমন হ্যাঁচকা টান মারলেন যে, যন্ত্রণায় আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। ভদ্রলোক এবার চুল ছেড়ে দিয়ে লজ্জিত গলায় বললেন, "মাপ করবেন, নকল চুল কি না দেখে নিলাম। কারণ দু-দুবার পরচুলা পরে ঠকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল আমাদের। চুলে রং করেও এসেছিল অনেকে।"
'এই বলে জানলার সামনে গিয়ে চেঁচিয়ে জানিয়ে দিলেন, লোক পাওয়া গেছে, আর কাউকে লাগবে না। এ কথা শুনে সবাই হতাশ হয়ে সরে পড়ল।
'ভদ্রলোক এবার নিজের পরিচয় দিলেন, "আমার নাম ডানকান রস। মি. হপকিন্স যে টাকা রেখে গেছেন, আমিও সেখান থেকে পেনশন পাই। মি. উইলসন, আপনি কি বিবাহিত? স্ত্রী-সন্তান আছে?"
'জবাবে যখন বললাম আমি নিঃসন্তান, সঙ্গে সঙ্গে তার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। আন্তরিক কণ্ঠে বললেন, "খুব খারাপ কথা। মনে কষ্ট পেলাম আপনার কথা শুনে। লালচুলোদের বংশবিস্তার আর তাদের ভরণ-পোষণের জন্যই খোলা হয়েছে এই ফান্ড।"
'কথাটা শুনে আমার মনখারাপ হয়ে গেল। বুঝলাম, চাকরিটা হচ্ছে না। কিন্তু কয়েক মিনিট চিন্তা করে মি. রস জানালেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার মতো আগুনলাল চুল যার মাথায় আছে তার জন্যে নিয়মের একটু হেরফের করাই যায়। তারপর জানতে চাইলেন কবে থেকে চাকরিতে যোগ দিতে পারব। 'জবাব দিলাম, "একটু ঝামেলা আছে। ছোটখাটো একটা ব্যবসা আছে আমার।"
'স্পন্ডিং বলে উঠল, "ব্যবসা নিয়ে আপনি ভাববেন না, মি. উইলসন। ওটা আমি আপনার হয়ে চালিয়ে নিতে পারব।"
"এখানে ডিউটি করতে হবে কতক্ষণ?" জানতে চাইলাম আমি।
"দশটা থেকে দুটো।"
'বন্ধকি কারবার চলে সাধারণত সন্ধের দিকে-বিশেষ করে বিষ্যুদ আর শুক্রবার সন্ধ্যায়। সকাল থেকে দুপুর অব্দি আমার কোনো কাজই নেই। কাজেই সেই ফাঁকে বাড়তি কামাই হলে ভালোই হয়। স্পন্ডিং ভালোমানুষ, ব্যবসা
ঠিকমতোই সামলাতে পারবে।
'ভেবেচিন্তে বললাম, "বেতন কত?" "সপ্তায় চার পাউন্ড ১৫৪।"
"কাজটা কী?"
"তেমন কিছু না।"
"তেমন কিছু না মানে কী?"
"পুরো সময়টা আপনাকে অফিসে, অন্তত এই বাড়িতে থাকতে হবে। এখান থেকে এক কদম নড়লেও চাকরি নট হয়ে যাবে। কোনো অবস্থাতেই এ ঘর ছেড়ে বেরোনো চলবে না। বেরোলেই চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন হবে।"
"অসুখ, জরুরি কাজ-কিছুতেই মাফ পাবেন না।"
"আচ্ছা। তা কাজ কী করতে হবে?"
"দিনে মাত্র চার ঘণ্টার ব্যাপার তো, ঠিক আছে, আমি বেরোব না," আশ্বস্ত করলাম আমি। 'কোনো অজুহাতেই কিন্তু বেরোনো চলবে না,' মি. ডানকান রস বললেন।
'এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা দেখে নকল করবেন। ব্যস, আর কিছু না। কালি, কলম, ব্লটিং পেপার আপনি নিয়ে আসবেন, চেয়ার-টেবিল আমরা
দেব। কাল থেকে আসতে পারবেন?" "নিশ্চয়," জবাব দিলাম আমি।
'সব ঠিকঠাক করে আনন্দে আটখানা হয়ে বাড়ি ফিরলাম। সারাদিন ভাবলাম ব্যাপারটা নিয়ে। সন্ধ্যার দিকে মনটা খারাপ হয়ে গেল আবার। কেবলই মনে হতে লাগল, গোটা ব্যাপারটাই একটা মস্ত ভাঁওতাবাজি। অমন উইল কেউ করে? নাকি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা কপি করার মতো মামুলি কাজের জন্যে কেউ এত টাকা বেতন দেয়? অবিশ্বাস্য ব্যাপার। স্পন্ডিং অবশ্য সমানে উৎসাহ জুগিয়ে চলল।
'যাহোক, সকালে উঠে স্থির করলাম, একবার গিয়ে দেখেই আসি ব্যাপারটা কী। এক পেনি দিয়ে একটা কালির বোতল কিনে, একটা পাখির পালকের কলম আর সাত তা ফুলঙ্কেপ কাগজ নিয়ে রওনা দিলাম পোপস কোর্টের দিকে। 'গিয়ে দেখি, ধাপ্পাবাজি নয়, সব ঠিকই আছে। চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থাও করা হয়েছে আমার জন্য। মি. ডানকান রসও ছিলেন। তিনি A অক্ষর থেকে শুরু করিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বলে গেলেন, মাঝে মাঝে এসে দেখে যাবেন কাজকর্ম ঠিকমতো চলছে কি না। ছুটি দিলেন দুপুর ঠিক দুটোর সময়। খুব প্রশংসা করলেন আমার কাজ দেখে।
'এভাবেই চলতে লাগল দিনের পর দিন। শনিবারে ম্যানেজার এসে এক সপ্তার বেতন, চারটে স্বর্ণমুদ্রা দিলেন। পরের হপ্তায়ও তা-ই। তার পরের সপ্তায়ও রোজ সকাল দশটায় গিয়ে হাজিরা দিই অফিসে, ফিরি বেলা দুটোয়। ধীরে ধীরে মি. ডানকান রসের অফিসে আসা কমতে লাগল, শেষে তার আসাই বন্ধ হয়ে গেল। তারপরও আমি কাজ চালাতে লাগলাম। ঘর ছেড়ে বেরোতাম না মুহূর্তের জন্যেও, পাছে তিনি কখন এসে পড়েন।
'আট সপ্তা কেটে গেল এভাবে। ততদিনে আমি Abbots, Archery, Armour, Architecture, Attica পর্যন্ত লিখে শেষ করে B-তে পৌঁছে গেছিস। একটা তাক প্রায় ভরে উঠেছে আমার লেখায়। তারপর হঠাৎ একদিন শেষ হয়ে গেল সব।'
'শেষ হয়ে গেল?' অবাক হয়ে বলল হোমস।
'হ্যাঁ, স্যার। আজ সকালের ঘটনা। সকাল দশটায় অফিস করতে গিয়ে দেখি দরজায় তালা মারা। তার গায়ে একটা নোটিস ঝোলানো। এই নিন, আপনি নিজেই পড়ে দেখুন।
নোটবই সাইজের একখানা চৌকোনা সাদা কার্ডবোর্ড এগিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। তাতে লেখা:
লালচুলো সংঘ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলো ১ অক্টোবর, ১৮৯০
লেখাটা পড়ে মুখ তুলতেই চোখে পড়ল মি. জ্যাবেষ উইলসনের বিষণ্ণ চেহারা। সেই চেহারা দেখে আর হাসি সামলাতে পারলাম না। হো-হো করে হেসে উঠলাম আমি আর হোমস। বন্ধুর হাসিতে তো গোটা বাড়িটাই কেঁপে উঠল।
রাগে আমাদের মক্কেলের আগুনলাল চুলগুলো সড়সড় করে দাঁড়িয়ে গেল।
No comments yet. Be the first to comment!